শতবর্ষের ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়

শতবর্ষের ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়

শতবর্ষ আগে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামের শিক্ষানুরাগী ও সমাজ হিতৈষি কিছু ব্যক্তি এবং গৌরীপুরের তত্কালীন জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ঐকান্তিক আগ্রহে কাঁচামাটিয়া নদীর তীরে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী হাই স্কুল।

বিদ্যালয়ের বর্তমান প্রধান শিক্ষক হাসিম উদ্দিনের সংগৃহিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার আগে ১৮৮০ সালে ঈশ্বরগঞ্জে চৌকি আদালত স্থাপিত হয়। ওই আদালত ঈশ্বরগঞ্জ, নান্দাইল ও গৌরীপুর থানার দেওয়ানী মামলা নিষ্পত্তির একমাত্র বিচারালয়। তিনজন মুন্সেফ বিচার কাজ পরিচালনা করতেন।

শতাধিক আইনজীবী ওই আদালতে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত ছিলেন। তাদের অধিকাংশের বসবাস ছিল ঈশ্বরগঞ্জ থানা সদরে। এছাড়াও তত্কালে ঈশ্বরগঞ্জে তিনটি সরকারি পাট গুদাম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরকারি অফিস আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসস্থল থানা সদরে হওয়ায় এখানে একটি মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

তত্কালীন শিক্ষানুরাগী আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাড়িনীকান্ত লাহিড়ী, বড়দারঞ্জন রায়, সতীশ চন্দ্র ঘোষসহ স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। এমনই এক মুহূর্তে গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ঈশ্বরগঞ্জে নিজ পরগণার তহসিল অফিস পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শনকালে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আদালতে কর্মরত আইনজীবীরা জমিদারের সঙ্গে সাক্ষাত্ করে তার স্মৃতির স্মারক হিসেবে আদালতের সামনে একটি স্কুল স্থাপনের জন্য জমিদারের কাছে অনুরোধ জানান।

শিক্ষানুরাগী জমিদার তাত্ক্ষণিক ইতিবাচক সাড়া দিয়ে তার মা বিশ্বেশ্বরী দেবীর নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপনের সম্মতি এবং এর জন্য ২.৮৮ একর জমি দান করেন। পাশাপাশি তিনি প্রয়োজনীয় আর্থিক ব্যয় মেটানোর জন্য স্থানীয় নায়েবকে এককালীন এবং মাসিক অর্থ বরাদ্দের নির্দেশ দেন।

এরপর ১৯১৬ সালে তার মায়ের নাম অনুসারে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘বিশ্বেশ্বরী হাই স্কুল’। পাকা ভিটির টিনশেড বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কালী কিশোর গুহ রায় সাতজন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঈর্ষণীয় ফলাফল করায় ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিদ্যালয়কে স্থায়ী মঞ্জুরি দান করে।

পরবর্তীতে ১৯৫৯ সালে ইস্ট পাকিস্তান এডুকেশন বোর্ড স্থায়ী মঞ্জুরি অনুমোদন করে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষায় ধারাবাহিক সাফল্যের জন্য ১৯৮০ সালে বিদ্যালয়টি পাইলট স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিদ্যালয়ে প্রতিবছর জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক বৃত্তি এবং জিপিএ ৫ পেয়ে আশানুরূপ ফলাফল করে আসছে।

বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ২২ জন শিক্ষক প্রায় ১৭শ শিক্ষার্থীকে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে পাঠদান করে আসছেন। দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবনে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত আধুনিক বিজ্ঞানাগারসহ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ।

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যারা সুনামের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে স্মরণীয় হয়ে আছেন তারা হলেন, কালী কিশোর গুহ রায়, ভূপেন্দ্র চন্দ্র লাহিড়ী, সুরেশ চন্দ্র লাহিড়ী, মুকুন্দ চন্দ্র চৌধুরী, সৈয়দ আব্দুর রাজ্জাক, হেলাল উদ্দিন, একেএম আব্দুল্লাহ, ওবায়দুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, এসএম আব্দুল লতিফ ও দীলিপ কুমার সরকার (ভারপ্রাপ্ত)।

এ বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে উচ্চ শিক্ষিত হয়ে দেশ ও জাতীর সেবায় যারা অবদান রেখেছেন তারা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য বর্তমানে আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সাত্তার, বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী সৈয়দ লুত্ফুল হক, কবি ও সাংবাদিক আব্দুল হাই মাশরেকী, বিশিষ্ট নাট্যকার ও কথা সাহিত্যিক বর্তমানে বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক ড. আমিনুর রহমান সুলতান, ঢাকা অ্যাপোলো হাসপাতালের চীফ কনসালটেন্ট ডা. মৃণাল কুমার সরকার প্রমুখ।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি আবু বকর সিদ্দিক দুলাল ভূঁইয়া জানান, লেখাপড়ার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা খেলাধুলায় জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। তাদের মধ্যে লিয়াকত হোসেন ১৯৭৮ সালে অ্যাথলেটিক্সে স্বর্ণ পদক, ১৯৯২ সালে একশ মিটার দৌড়ে আরমান স্বর্ণ পদক এবং ২০০৩ সালে কথক নৃত্যে যুথিকা লাহিড়ী স্বর্ণপদক লাভ করেন। দেশ মাতৃকার ডাকে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরের খাতায় নাম লিখিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই, হাবিবুর রহমান হলুদ, নজরুল ইসলাম আজিজ, লিয়াকত হোসেন, নুরুল আমিন সুরুজ, রঞ্জন কুমার মজুমদার, মিরাশ উদ্দিন ও ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার।

০৩ জানুয়ারি, ২০১৭ তারিখ প্রকাশিত নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *