ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি

ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি

সাহিত্য সংস্কৃতি ও শিল্পকলায় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অধিকারী ময়মনসিংহের কীর্তি সর্বজনবিদিত। মোমেনশাহীর নতুন ইতিহাস, ময়মনসিংহের জীবন ও জীবিকা, মৈমনসিংহ গীতিকা, গেজেটিয়ার ময়মনসিংহ ইত্যাদি গ্রন্থে ময়মনসিংহের সংস্কৃতি চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। এই ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার অন্যতম একটি জনপদের নাম আঠারবাড়ী। এখানে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিড়রিত আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি। যেটি আঠারবাড়ী রাজবাড়ি নামেও পরিচিত।

ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে একটি গ্রামের নাম আঠারবাড়ী। এই গ্রামে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি। মূলত এই জমিদার বাড়ি থেকেই এই গ্রামের নাম আঠারবাড়ী হয়েছে। এই জমিদার বাড়ির অনেক ইতিহাস আছে। এই জমিদার বাড়িতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছিলেন।

ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ী জমিদার বাড়ি

জানা যায়, ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হোসেন শাহী পরগনা রাজশাহী কালেক্টরের অধীনে ছিল। সে সময় মহারাজ রামকৃষ্ণের জমিদারি খাজনার দায়ে নিলামে উঠলে এ পরগনাটি ‘খাজে আরাতুন’ নামে এক আর্মেনীয় ক্রয় করেন। ১৮২২ খৃষ্টাব্দে আরাতুনের ২ মেয়ে বিবি কেথারিনা, বিবি এজিনা ও তার ২ আত্মীয় স্টিফেন্স ও কেসপার্জ প্রত্যেকে ৪ আনা অংশে এ পরগনার জমিদারি লাভ করেন। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে আঠারবাড়ির জমিদার শম্ভুরায় চৌধুরী, বিবি এজিনার অংশ মতান্তরে কেসপার্জের অংশ ক্রয় করেন। পরে মুক্তাগাছার জমিদার রামকিশোর চৌধুরীর জমিদারি ঋণের দায়ে নিলামে উঠলে তা শম্ভুরায় চৌধুরীর পুত্র মহিম চন্দ রায় চৌধুরী কিনে নেন।

জমিদার সম্ভুরায় চৌধুরীর পিতা দিপ রায় চৌধুরীর প্রথম নিবাস ছিল বর্তমান যশোর জেলায়। তিনি যশোর জেলার একটি পরগনায় জমিদার ছিলেন। সুযোগ বুঝে এক সময় দিপ রায় চৌধুরী তার পুত্র সম্ভুরায় চৌধুরীকে নিয়ে যশোর থেকে আলাপ সিং পরগনায় অর্থাৎ আঠারবাড়ী আসেন। আগে এ জায়গাটার নাম ছিল শিবগঞ্জ বা গোবিন্দ বাজার। দীপ রায় চৌধুরী নিজ পুত্রের নামে জমিদারি ক্রয় করে এ এলাকায় এসে দ্রুত আধিপত্য স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং এলাকার নাম পরিবর্তন করে তাদের পারিবারিক উপাধি “রা” থেকে রায় বাজার” রাখেন । আর রায় বাবু একটি অংশে এক একর জমির উপর নিজে রাজবাড়ি, পুকুর ও পরিখা তৈরি করেন। রায় বাবু যশোর থেকে আসার সময় রাজ পরিবারের কাজকর্ম দেখাশুনার জন্য আঠারটি হিন্দু পরিবার সঙ্গে নিয়ে আসেন। তাদের রাজবাড়ি তৈরি করে দেন। তখন থেকে জায়গাটি আঠারবাড়ী নামে পরিচিত লাভ করে।

দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল জমিদার বাড়িটি এখনও ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নীরবে দাড়িয়ে আছে। চমৎকার কারুকার্যময় এ রাজবাড়ীটির বয়স প্রায় আড়াই শত বছর। এই বাড়িটির নান্দনিক কারুকার্য ও সবুজে ঘেরা পরিবেশ সবার দৃষ্টি কাড়বে। শহরের কোলাহল মুক্ত পরিবেশে দাড়িয়ে থাকা বাড়িটি এখনও যেন নীরবে জমিদারি করছে ঐ এলাকায়।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহের আঠারবাড়ী ভ্রমণ করেছিলেন। আঠারবাড়ীর তৎকালীন জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরীর আমন্ত্রণে ১৯২৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি জমিদার বাড়ি পৌঁছান। সেখানে তার সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও বাউল, জারি-সারি গানের আসর বসানো হয়েছিল। আঠারবাড়ীর জমিদার প্রমোদ চন্দ্র রায় চৌধুরী শান্তি নিকেতনের শিক্ষার্থী ছিলেন। কবিগুরু ছিলেন তার শিক্ষক। বিশ্বকবি তার এই ছাত্রের আমন্ত্রণ রক্ষা করতেই আঠারবাড়ী এসেছিলেন।

এই জমিদারবাড়িকে ঘিরে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আঠারবাড়ী ডিগ্রি কলেজ। ডিগ্রি কলেজ প্রধান ফটক পার হয়ে ভিতরে ঢুকলে চোখে পড়বে বিশাল খেলার মাঠ এবং তার বিপরীতে জমিদার বাড়ীর অন্দরমহল। এগিয়ে গেলে পুরোনো শ্যাওলা পরা ভবনগুলো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। অন্দরমহলে নাচের জায়গা, চাকরবাকর থাকার ঘর, সুবিশাল একটি অট্টালিকা চোখে পড়বে যার প্রতিটি খাঁজ সুন্দর কারুকাজ করাছিল দেখে বুঝা যায়। এসব পার হয়ে কলেজের ভিতরে গেলে কাছারি বাড়ি ও দরবার হল। ভবনের উপরে রয়েছে সুবিশাল এক টিনের গম্ভুজ। পিছনে সারি সারি গাছ। সামনে রাণীপুকুর। যে পুকুরে রাজবাড়ির মানুষজন গোসল করতো। এই পুকুরে আসার জন্য অন্দরমহল থেকে গোপন গুহা ছিল মাটির নিচ দিয়ে। এই পুকুরে এক সময় কুমির ও বড় বড় মাছ ছিল বলে ধারণা করেন ইতিহাসবিদরা।

যাওয়ার উপায়:

আঠারবাড়ী যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে ময়মনসিংহ শহরে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে ময়মনসিংহে যাওয়ার জন্য মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে এনা, শামীম এন্টারপ্রাইজ, সৌখিনসহ কয়েকটি পরিবহন বাস রয়েছে। সময় লাগবে আড়াই থেকে চার ঘণ্টা। এছাড়াও কমলাপুর, বিআরটিসি বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকা-নেত্রকোণা রুটের গাড়িতেও ময়মনসিংহে যেতে পারবেন। এনা ট্রান্সপোর্টে ভাড়া জনপ্রতি ২২০ টাকা। তাছাড়া সৌখিন পরিবহনের ভাড়া ১৫০ টাকা।

এছাড়া ঢাকা থেকে ট্রেনে করেও যেতে পারেন ময়মনসিংহ। ঢাকা থেকে তিস্তা এক্সপ্রেস (সকাল সাতটা বিশ), মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস (দুপুর দুইটা বিশ), যমুনা এক্সপ্রেস (বিকাল চারটা চল্লিশ), অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস (সন্ধ্যা ছয়টা) ও হাওর এক্সপ্রেস (রাত এগারোটা পনেরো) ময়মনসিংহেরে উদ্দেশ্যে ছাড়ে। ভাড়া শ্রেণিভেদে ১০০ থেকে ৩৬০ টাকা।

ময়মনসিংহ শহর থেকে আঠারবাড়ী রাজবাড়ীতে যেতে চাইলে ট্রেন, বাস অথবা সিএনজি করে যেতে পারবেন। ময়মনসিংহ হতে ভৈরব গামী ট্রেনে আঠারবাড়ি রেলস্টেশনে নেমে যাওয়া যাবে এবং ময়মনসিংহ বা কিশোরগঞ্জগামী বাসে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় নেমে আঠারবাড়ীগামী অটো বা সিএনজি করে যাওয়া যাবে। আঠারবাড়ী বাজার থেকে হেঁটে বা রিকসা করে রাজবাড়ীতে যেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন: থাকার জন্য ময়মনসিংহ শহরে রয়েছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে– আমির ইন্টারন্যাশনাল (০১৭১১১৬৭ ৯৪৮), হোটেল মুস্তাফিজ ইন্টারন্যাশনাল (০১৭১৫১৩৩ ৫০৭), হোটেল হেরা (০১৭১১১৬৭ ৮৮০), হোটেল সিলভার ক্যাসল (০৯১৬৬১৫০, ০১৭১০৮৫৭ ০৫৪), হোটেল খাঁন ইন্টারন্যাশনাল (০৯১৬৫৯৯৫) প্রভৃতি।

খাওয়া দাওয়া: ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থল প্রেসক্লাব ক্যান্টিনের মোরগ পোলাও এর ব্যাপক সুনাম রয়েছে। এছাড়া নতুন বাজার হাজী বিরিয়ানি, হোটেল সারিন্দা ও হোটেল ধানসিঁড়িও ভালো। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে মাঝারি ও নিম্নমানের বেশ কিছু খাবার হোটেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *