রাত কাটে নির্জন বিলে কখনও বনজঙ্গলে
ডেস্ক নিউজঃ কখনও নির্জন বিলে, কখনও বনজঙ্গলে, আবার কখনও ফসলের মাঠে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে খোলা আকাশের নিচে রাতে তাঁবু গেড়ে আজ এখানে তো পরের দিন নতুন জায়গার খোঁজে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে গেলেও বিপদ। খোঁজ নিয়ে সেখানেও ঠিকই পৌঁছে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ময়মনসিংহে এভাবেই কাটছে বিএনপি নেতাকর্মীর ফেরার জীবনের দুঃসহ রাত।
পরিবার-পরিজন ছাড়া জীবনে এমন দুঃসময় নেমে আসবে– ভাবনায় ছিল না এসব নেতাকর্মীর। কারও মা সন্তানের জন্য শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন, কারও স্ত্রী-সন্তান অপেক্ষায় থাকছেন প্রিয়জনকে এক পলক দেখতে। মোবাইল ফোনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছেন না ধরা পড়ার ভয়ে।
তাঁবুতে রাত কাটানোর ছবি রোববার নিজের ফেসবুকে আপলোড করেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মোবারক হোসেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই ছবির সত্যতা নিশ্চিত করে সমকাল। মোবারকের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের ধামদী গ্রামে। একটি ওষুধ কোম্পানির আঞ্চলিক ডিলার তিনি। এক মাসের বেশি সময় ফেরার থাকার কারণে তাঁর ব্যবসা লাটে উঠেছে।
গতকাল সোমবার বিকেলে গৌরীপুরের বোকাইনগর ইউনিয়নের বেতান্দর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মোবারকের সঙ্গে কথা হয়। নিজ উপজেলায় থাকতে না পেরে গৌরীপুরে এসে যাযাবর জীবন কাটাচ্ছেন। তিনি জানান, তাঁর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা রয়েছে দুটি। ২০১৬ সালে গ্রেপ্তার হয়ে এক মাস জেলও খেটেছিলেন। বিএনপির চলমান আন্দোলন কর্মসূচিতে ঈশ্বরগঞ্জ আসনের বিএনপির সাবেক এমপি শাহ নূরুল কবীর শাহীনের সমর্থনে কার্যক্রম চালান তিনি। কখনও বিলের মাঝে, কখনও গহিন জঙ্গলে রাত কাটান। শুরুর দিকে স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিলেও এখন আর থাকতে পারেন না।
মোবারক বলেন, কিছুদিন আগে চাচা মারা গেলে গোপনে জানাজায় যাই। স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন দেখতে পেলেই পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবে– এ ভয়ে বাড়িতে যেতে পারি না। নতুন কোনো মামলায় আসামি হিসেবে আমার নাম নেই। তবে পুলিশ ধরতে পারলেই মামলায় ঢুকিয়ে দেবে। আমাকে ধরতে মাঝেমধ্যেই বাড়িতে পুলিশ গিয়ে তল্লাশি চালায়। তাই ফেরার জীবন কাটাচ্ছি।
এমন ফেরার জীবন শুধু মোবারকের নয়। স্থানীয় অনেক বিএনপি নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা দিনের বেলায় কেউ নিজেদের এলাকায় চুপিচুপি গেলেও রাত তাদের জন্য ভয়ের। নিজ উপজেলার বাইরে বিভিন্ন এলাকার নির্জন স্থানে কষ্টে রাত কাটাতে হয়।
গতকাল সন্ধ্যার পর গৌরীপুরের বোকাইনগর ইউনিয়নের নাহড়া বোর্ড বাজারে জড়ো হন ছাত্রদল-যুবদলের কয়েকজন নেতা। সেখানে কথা হয় আঠারাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রদলের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান ফরহাদের সঙ্গে। তিনি জানান, ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ১১টি মামলা হয়েছে। নিজ এলাকায় থাকতে পারেন না প্রায় তিন মাস। এ এলাকার ডালিয়া বিলে তাঁবু গেড়ে রাত কাটাচ্ছেন কিছুদিন ধরে। কোনোদিন কেন্দুয়া, কোনোদিন নান্দাইল কিংবা গৌরীপুরে রাত কাটান তিনি।
আঠারবাড়ি বাজারের মনিহারি ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া শামীম নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও যেতে পারেন না। দেড় মাস ধরে লুকিয়ে আছেন। ঢাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে একবার গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছিলেন বলে জানান তিনি।
ময়মনসিংহ উত্তর জেলা যুবদলের মৎস্য ও পশুপালনবিষয়ক সম্পাদক হুমায়ুক কবীর লিটন বলেন, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তিন দিন পুলিশ বাড়িতে তল্লাশি চালায়। এ ভয়ে বাড়িতে থাকতে পারি না।
মাজইবাগ ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল বাশার নিজেও ফেরার জীবন কাটান। পুলিশের ভয়ে পাশের নান্দাইলে নিজের ব্যবসা সরিয়ে নিয়েছেন। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে প্রায় তিন মাস ধরে থাকতে পারেন না এ নেতা।
কথা হয় নেত্রকোনা জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফ আহম্মেদ রব্বানি ভূঁইয়া রাজুর সঙ্গে। নিজের এলাকায় থাকতে পারেন না বলে রাত কাটান গৌরীপুরসহ আশপাশের এলাকায়। রাজু জানান, আন্দোলনের সমর্থনে এলাকায় কর্মসূচি করার পর থেকে পুলিশের টার্গেটে পরিণত হয়েছি। প্রতিদিন পুলিশ বাড়িতে তল্লাশি চালায়। পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হয়রানি করেছে।
ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার নিজেও ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন স্থানে থাকছেন। তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ২৭টি মামলা রয়েছে। গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে নতুন করে ৬টি মামলা হয়। এর পর থেকে পরিবারের সঙ্গে দেখা নেই।