মোড়ল প্রথা

অবশেষে উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে বন্ধ হলো মোড়ল প্রথা

ডেস্ক নিউজঃ ঈশ্বরগঞ্জে একটি জেলেপাড়ায় কোনো ছেলের বিয়ে করাতে হলে ধাপে ধাপে ১৯ বার মোড়লদের অনুমতি নিতে হতো। অনুমতি না নিলে শাস্তি হিসেবে ওই পরিবারকে ‘একঘরে’ করে রাখা হতো। সম্প্রতি একটি পরিবারকে এক মাসেরও বেশি সময় এই শাস্তির আওতায় রাখার অভিযোগ পেয়ে, প্রশাসনের হস্তক্ষেপে দীর্ঘদিনের ওই ‘মোড়ল প্রথা’ বিলুপ্তি ঘটেছে।

ঈশ্বরগঞ্জ পৌর এলাকার ধামদী গ্রামের ভুক্তভোগী ওই পরিবারটি বুধবার এ প্রথার বিলুপ্তি চেয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদন করে।

পরে সন্ধ্যায় ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহবুবুর রহমান জেলেপাড়ায় গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ প্রথা বাতিল করে দিয়েছেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন—স্থানীয় কাউন্সিলর জহিরুল হক সুজন, সনাতন সম্প্রদায়ের জেলেপাড়ার বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা বলছে, ধামদী গ্রামে অন্তত ৭০ জেলে পরিবারের বসবাস। গত ১৬ জুলাই মনোরঞ্জন বর্মণের ছেলে পুণ্য বর্মণকে বিয়ে করানো হয়। কিন্তু বিয়ের জন্য পাত্রী দেখতে যাওয়ার আগে পাড়ার মোড়লদের অনুমতি নেয়নি পরিবারটি। তবে পাড়া থেকে একজনকে সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল। পাত্রী দেখতে গিয়ে বিয়ে ঠিক হয়। পরে সমাজের মোড়লদের জানাতে গিয়ে তোপের মুখে পড়েন তাঁরা।

অভিযোগে ভুক্তভোগী পরিবারটি জানায়, পুণ্য বর্মণের বিয়ের পাকা কথা হওয়ার আগে পাড়ার মোড়ল অবনি বর্মণ ও সহকারী মোড়ল মঙ্গল বর্মণের অনুমতি না নেওয়ায় তারা আপত্তি তোলেন। বুঝিয়ে বলার পরও মোড়লেরা সাত দিন পর সিদ্ধান্ত দেওয়ার কথা জানান। মোড়লদের আবদার মেনে না নিয়ে, পুণ্য বর্মণের বিয়ে সম্পন্ন করায় পরিবারকে একঘরে করার সিদ্ধান্ত হয়। যদি এ সিদ্ধান্ত কেউ না মানে, তবে তাঁকেও একঘরে করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

বিয়েতে অংশ নেওয়ায় পুণ্য বর্মণের মামা প্রীতিষ ভৌমিক ও মুক্তি ভৌমিকের পরিবারকেও একঘরে করে রাখা হয়। তারা গত ১৬ আগস্ট পঞ্চায়েত বৈঠকে ক্ষমা চেয়ে সমাজের সঙ্গে মিলে যায়। তবে সে সময়ও মনোরঞ্জন বর্মণের পরিবারকে একঘরে থাকার সিদ্ধান্তও বলবৎ থাকে।

সরেজমিনে জেলেপাড়ায় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো বিয়ে করতে সেখানে মোড়লদের কাছ থেকে ১৯ বার অনুমতি নিতে হয়। যেমন-পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় মোড়লের অনুমতি নিয়ে তাঁর প্রতিনিধিসহ পাত্রীর বাড়ি যেতে হয়। পাত্রী পছন্দ হলে মোড়লের অনুমতি নিয়ে পাকা কথা বলে উলুধ্বনি দিতে হয়। বিয়ে ঠিক হলে মহল্লার প্রতি ঘর থেকে প্রতিনিধি এলে সবাইকে ডেকে মোড়লকে জোড় হাত করে বিস্তারিত বলতে হয়। পাত্রীপক্ষ, পাত্রপক্ষের কেউ বাসায় এলে মোড়লকে আবার জানাতে হয়। বউভাতের দিন রান্না শুরু করার আগে মোড়লের অনুমতি নিয়ে চুলায় আগুন দিতে হয়। এভাবে সব মিলিয়ে ১৯ বার অনুমতি নেওয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল।

ভুক্তভোগী পরিবারের মনোরঞ্জন ও তাঁর স্ত্রী সুর ধনী বর্মণ জানান, আত্মীয়-স্বজনদেরও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করা হয়েছিল।

রিপন বর্মণ বলেন, ‘মোড়লদের অনুমতি না নিয়ে পাত্রী দেখায় আমার পরিবারকে দীর্ঘদিন যাবৎ একঘরে করে রাখা হয়েছিল। পরে আমি আইনের মোড়ল প্রথার বিলুপ্তি চেয়ে প্রশাসনের কাছে আবেদন করি। পরে এসিল্যান্ড মহোদয় মোড়লদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং সবার সম্মতিতে মোড়ল প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এতে আমার পরিবারের সবাই আশ্বস্ত হয়েছেন।’ ভবিষ্যতে এর কোনো ব্যত্যয় ঘটলে ফের প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

এ বিষয়ে জেলে পাড়ার মোড়ল অবনি বর্মণ বলেন, ‘এই প্রথাটা আমাদের পূর্ব পুরুষের রেওয়াজ ছিল। সেই রেওয়াজ অনুযায়ী পাড়ার যে কেউ একজন মুরুব্বি প্রধান হিসেবে ভালো-মন্দ কাজে সর্বদা নির্দেশনা দেবে। এর বাইরে অন্য কিছু নয়। যেহেতু প্রশাসনের লোকজন এসে বলেছে মোড়ল প্রথার সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি মেনে নিয়েছি। তবে ব্যক্তিগতভাবে কেউ আমাকে সম্মান করলে এই বিষয়ে তো আর কিছু করার নাই।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রে অন্য কোনো আইন বা প্রথা প্রয়োগের সুযোগ নেই। বিষয়টি জেলেপাড়ায় গিয়ে জেলে সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের বুঝিয়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে একঘরে করে রাখা সংক্রান্ত বিষয়টির সমাধান করা হয়। এ ছাড়াও মোড়ল প্রথা বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *