লোককবি আবদুল হাই মাশরেকী

আবদুল হাই মাশরেকী

আবদুল হাই মাশরেকী (১ এপ্রিল ১৯০৯ – ৪ ডিসেম্বর ১৯৮৮) ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত লোক সাহিত্যিক এবং কবি।তিরিশ ও চল্লিশ দশকে তিনি সাহিত্য জগতে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলেন। মূলত গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষদের জীবনগাঁথাই তার লেখনিতে স্থান পেয়েছিল।

তার লেখা অসংখ্য পালাগান, দেশাত্ববোধক গান, কবিতা ও গণসংগীতের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, ‘রাখাল বন্ধু’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘আল্লা মেঘ দে ছায়া দে’, ‘ফান্দে পরিয়া বগা কান্দে রে’, ‘হে আমার দেশ’, ‘কিছু রেখে যেতে চাই’সহ আরও অনেক।

তার লেখা ছিল সামাজিক বৈষম্য, অর্থনিীতি, ধর্মীয় ও বর্ণবাদের বিরোদ্ধে। বাংলা সাহিত্যের গবেষক মিহির আচার্য, ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল সময়কালের মধ্যে তিনজন প্রধান লোক কবির কথা উল্লেখ করেন যার মধ্যে আবদুল হাই মাশরেকী অন্যতম। অপর দুজন হলেন জসীম উদ্ দীন এবং বন্দে আলী মিয়া।

কবি আবদুল হাই মাশরেকী
জন্ম ১ এপ্রিল ১৯০৯
কাঁকনহাটি, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যু ৪ ডিসেম্বর ১৯৮৮ (বয়স ৭৯)
দত্তপাড়া, ঈশ্বরগঞ্জ, ময়মনসিংহ
পেশা কবি, গীতিকার, নাট্যকার ও গল্পকার
জাতীয়তা বাংলাদেশী
নাগরিকত্ব বাংলাদেশ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি বাংলা সাহিত্যে সনেটে ও কাব্যে গ্রাম বাংলার লোকজ শব্দ প্রথম ব্যবহার করেন তিনি।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাহিত্য পুরস্কার, প্রভাতি একুশে পদক
দাম্পত্যসঙ্গী সালেহা মাশরেকী
সন্তান মমতা, আনারকলি, স্বপ্না, পুষ্প (৪ মেয়ে); নোমান, নঈম, শামীম, মামুন (৪ ছেলে)

জন্ম ও শিক্ষা


আবদুল হাই মাশরেকী ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কাঁকনহাটি গ্রামে ১৯০৯ সালের ১ এপ্রিল (সার্টিফিকেট অনুসারে ১৯১৯) মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওসমান গণি সরকার যিনি জমিদার বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন ও মাতা রহিমা খাতুন। শিক্ষাজীবনের প্রথমে দিকে তিনি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে কলকাতা পাড়ি জমান।

কর্ম ও সাহিত্য জীবন


অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় তার প্রথম গ্রন্থ ‘চোর’ (গল্প) প্রকাশিত হয়। কলকাতা থাকাকালীন তিনি এইচএমভি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিতে গান লেখার কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে তিনি পূর্ববঙ্গে চলে আসেন এবং পরবর্তীতে ঢাকার এইচএমভির হয়ে চুক্তিভিত্তিক গান লিখলেও এখানে কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। তার কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কাটে শিক্ষকতা, জুট রেগুলেশন, দৈনিক বাংলা পত্রিকার সহ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।

১৯৭৬ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পূর্বপর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রনালয়ের ম্যাগাজিন ‘কৃষিকথার’ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিযোজিত ছিলেন। কবি আবদুল হাই মাশরেকী ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। তার লেখা ‘ওরে আমার ঝিলাম নদীর পানি’ ১৯৬৭-৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রীয় ‘তঘমাই ইমতিয়াজ’ পুরস্কার লাভ করে কিন্তু তিনি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

১৯৪১ সালে তার লেখা ‘ফান্দে পরিয়া বগা কান্দে রে’ গানটিতে কণ্ঠ দেন উল্লেখযোগ্য কণ্ঠশিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ।

১৯৫০-এর দশকে তার অন্যতম উল্লেখযোগ্য দুটি লেখা “কুলসুম গল্প” এবং “বাউল মনের কথা” কলকাতার ননী ভৌমিক কর্তৃক রুশ ভাষায় অনুবাদ করা হয়। মূলত কলকাতাতে থাকাকালীনই তার লেখা কবিতা, গান, গল্প, নাটক ও প্রবন্ধ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এসময়ই তার লেখা গানগুলো রেকর্ড আকারে প্রকাশিত হয় কলকাতায় ও দেশ বিভাগের পর বাংলাদেশেও প্রকাশ হতে শুরু করে। সেসময়ের বহুল প্রচারিত আকাশবাণী, তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ বেতারে নিয়মিত তার গান প্রচার করা হত।

আবদুল হাই মাশরেকী ১৯৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রকাশিত গ্রন্থাবলী


আবদুল হাই মাশরেকীর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে:

  • রাখাল বন্ধু (পালাগান)
  • জরিনা সুন্দরী (পালাগান)
  • কিছু রেখে যেতে চাই (কাব্য)
  • হে আমার দেশ (কাব্য)
  • কুলসুম (গল্প)
  • বাউল মনের নকশা (গল্প)
  • মাঠের কবিতা মাঠের গান (কাব্য)
  • দুখু মিয়ার জারি (জারি গান)
  • মানুষ ও লাশ (গল্প)
  • নদী ভাঙে (গল্প)
  • ভাটিয়ালী (গীতিনাট্য ও কাব্য)
  • অভিশপ্তের বাণী (কাব্য)
  • দেশ দেশ নন্দিতা (কাব্য)
  • কাল নিরবধি (কাব্য)
  • ডাল ধরিয়া নুয়াইয়া কন্যা (পল্লীগীতিকা)
  • হযরত আবু বকর (পুঁথি কাব্য)
  • স্বদেশের প্রতি হযরত মোহাম্মদ (কাব্য)
  • নতুন গাঁয়ের কাহিনী (নাটক)
  • সাঁকো (নাটক)
  • হুতুম ভুতুম রাত্রি (ছোটদের কাব্য)
  • আকাশ কেন নীল (অনুবাদ)

আরো জানতে: গল্প নয় সত্যি কবি আবদুল হাই মাশরেকী

4 thoughts on “আবদুল হাই মাশরেকী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *