আবদুল হাই মাশরেকী ব্যক্তি ও কবি

আবদুল হাই মাশরেকী ব্যক্তি ও কবি

ডেস্ক নিউজঃ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে লোকজীবনাশ্রয়ী কাব্যধারার অন্যতম কবি আবদুল হাই মাশরেকী। বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক জীবনধারার প্রতিনিধিত্বকারী এ কবি গ্রামীণ জীবনবোধ ও সমাজ-বাস্তবতার বিশ্বস্ত রূপকার। চিরায়ত গ্রামবাংলার মাটিলগ্ন কৃষকজীবনের আকাঙ্খা ও সংবেদনাকে সহজ-সরল বাগ্ভঙ্গিমায় আন্তরিক দরদের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন তাঁর সাহিত্যকর্মে। উপজীব্য হিশেবে গ্রামজীবনকে অবলম্বন করেও তাঁর রচনার প্রকাশভঙ্গি নিঃসন্দেহে আধুনিক।

আবদুল হাই মাশরেকীর জন্ম ১ এপ্রিল ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ কাঁকনহাটি গ্রামে মাতুলালয়ে। পৈতৃক নিবাস একই উপজেলার দত্তপাড়া গ্রামে। মাশরেকীর শৈশব কাটে স্বগ্রাম দত্তপাড়ায়। বাড়ির পাশ ঘেঁষেই বয়ে গেছে কাঁচামাটিয়া নদী। নদীবিধৌত পলিমাটির সোঁদা গন্ধ, ফসলি মাঠের সবুজিমা, বনের কাজল ছায়া, মেঘ ও নীলিমা তাঁর মনের আকাশে এঁকে দেয় স্বপ্ন ও কল্পনার রামধনু। ছায়াসুনিবিড় পল্লিপ্রকৃতি, স্বভাব-সরল গ্রামীণ জীবন, ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি কবির শিশুকিশোর মনে স্থায়ী ছাপ রেখে যায়। উত্তরকালে স্বভাবতই তাঁর সাহিত্যকর্মে সে-সবের প্রতিফলন ঘটে।

শৈশবে পিতৃগৃহে থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন মাশরেকী। পরে কাঁকনহাটি গ্রামের মামাবাড়ি থেকে প্রথমে স্থানীয় চরনিখলা মধ্য ইংরেজি স্কুলে পড়ালেখা করেন এবং পরে জাটিয়া হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। এরপর মযমনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অকালে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনে ছেদ পড়ে।

আর্থিক অনটনে মাশরেকীর বিদ্যায়তনিক শিক্ষা পূর্ণতা পায়নি; অচিরেই তাঁকে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। ময়মনসিংহের গৌরীপুরে জুট রেগুলেশনে বছরখানেক চাকরি করার পর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি চলে যান কলকাতা। সেখানে তিনি সিভিল সাপ্লায়ার্স বিভাগে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চাকরি করেন। ছেচল্লিশের দাঙ্গার কারণে সাতচল্লিশের গোড়ার দিকে ফিরে আসেন জন্মস্থান ঈশ্বরগঞ্জে।

কিন্তু ফেলে আসেন কবি নজরুলের উপহার দেয়া হারমোনিয়ামসহ স্বরচিত দুটি পা-ুলিপি ‘অভিশপ্তের বাণী’ (কবিতা) ও ‘ঝিঙা ফুলের লতা’ (গীতিনাট্য)। ফিরে এসে স্থানীয় চরনিখলা প্রাইমারি স্কুলে কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। অতঃপর তিন বছর বেকার জীবন কাটিয়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ‘দৈনিক সংবাদ’-এ সাব-এডিটর পদে যোগদান করেন।

সংবাদে বছরখানেক কাজ করার পর ১৯৫২-এর ২ জানুয়ারি কৃষি তথ্য সংস্থার ‘মাসিক কৃষিকথা’ পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিশেবে যোগ দিয়ে ১৯৬৬তে উপসম্পাদক এবং ১৯৬৫তে সহকারী সম্পাদক পদে উন্নীত হন। দীর্ঘ ২৪ বছর ‘কৃষিকথা’র সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্বপালন শেষে ১৯৭৬-এর ১ এপ্রিল সহকারী সম্পাদক হিশেবে মাশরেকী সরকারি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন।

স্কুলজীবনেই সাহিত্যে হাতেখড়ি হয় মাশরেকীর। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ালেখাকালেই তাঁর লেখা গল্প ‘চোর’ বিদ্যালয়ের হাতে লেখা পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে। ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকসাহিত্যের ঐতিহ্যিক পরিম-ল, যাত্রা-জারি-নাটক ও পালাগানের সুরেলা আবহ মাশরেকীর কিশোর চিত্তকে রসাপ্লুত করে। ফলে তাঁর মনোলোকে সঞ্চারিত হয় সাহিত্যানুরাগ এবং স্ফুরণ ঘটায় তাঁর সৃষ্টিশীলতার।

মাশরেকীর লেখা কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক চাষী’ পত্রিকায় ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। অতঃপর ওই বছরই তিনি ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমান কলকাতা। কলকাতা বাসকালেই তাঁর সৃষ্টিশীলতার জোয়ার আসে এবং অজস্র কবিতা ও গান লেখেন। একই সঙ্গে এ সময়ে উপযুক্ত প্রকাশ-মাধ্যম খুঁজে পায় তাঁর রচনা। ১৯৪৪ থেকেই তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে ওঠেন।

লেখালেখির শুরুতে কবি তাঁর পিতৃদত্ত ‘আবদুল হাই’ নামই ব্যবহার করতেন। কিন্তু ১৯৪৫-এর দিকে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায় আলোচ্য একই নামের একাধিক লেখকের আবির্ভাব ঘটে। এ সময়ে ‘মোহাম্মদী’র কোনো এক সংখ্যায় তিনজন আবদুল হাই-এর লেখা ছাপা হলে অতঃপর সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় কটাক্ষ করে মন্তব্য করা হয় যে, অমুক সংখ্যা মোহাম্মদীতে তিনজন আবদুল হাই মিলে একটা মস্ত বড় ‘হাই’ তুলেছেন। এ ঘটনার পরেই কবি আবদুল হাই তাঁর নামের শেষে ‘মাশরেকী’ শব্দটি জুড়ে দিয়ে ‘আবদুল হাই মাশরেকী’ হয়ে ওঠেন।

চল্লিশের দশকের মধ্যভাগ থেকে সত্তরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত মাশরেকীর লেখালেখি উভয় বাংলা তথা কলকাতা ও ঢাকার পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। এ কালখ-ে তাঁর লেখা কবিতা, গান ও ছোটগল্প নানা কাগজে পত্রস্থ হয়। দুটি নাটক ও কিছু অনুবাদকর্মও তিনি করেছেন। বেশকিছু গীতিনাট্যেরও রচয়িতা তিনি। যেসব সাময়িক পত্রিকায় মাশরেকীর রচনা প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর মধ্যে মোহাম্মদী, পরিচয়, দিলরুবা, সওগাত, মাহে-নও, পূবালী, কৃষিকথা, এলান প্রভৃতির নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

গ্রামবাংলার ভূমিপুত্র আবদুল হাই মাশরেকী। ঐতিহ্যের শেকড় ধরেই তাঁর শিল্পীসত্তার অঙ্কুরোদ্গম ও বেড়ে ওঠা। কবির প্রাণমূলে সৃষ্টিশীলতার রসদ জুগিয়েছে চিরায়ত লোকসাহিত্য, মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, পুঁথি সাহিত্য, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, পল্লিগীতি ইত্যাদি। লোকসাহিত্যের উত্তরাধিকারকে আত্মস্থ করে নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক জীবন, জন-সংস্কৃতি ও সমাজচিত্রকে শিল্পিত রূপ দিয়েছেন কবি তাঁর সৃষ্টিকর্মে।

মাশরেকী ছিলেন গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান বিস্তৃত গ্রামবাংলার ধুলো-কাদা-মাটিলগ্ন খেটে-খাওয়া মানুষের প্রাকৃত জীবনচিত্র তাঁর রচনায় বাক্সময় হয়ে উঠেছে। সে কারণেই সুধীমহল তাঁকে ‘মাটি ও মানুষের কবি’ অভিধায় ভূষিত করেছেন।

আবদুল হাই মাশরেকীর কবি-চারিত্র মূলত রোমান্টিক ও মিস্টিক। প্রায়শ তাঁর কবিতায় ও গানে মরমিয়া সুর বেজে ওঠে। পটভূমি বিচারে মাশরেকীর কাব্যধারায় দুটি ভাগ লক্ষ করা যায়; একটি প্রকৃতি ঘনিষ্ঠ গ্রামজীবন আর অন্যটি নগর-প্রতিবেশ। প্রথমোক্ত ধারার কবিতা-সংকলন ‘মাঠের কবিতা মাঠের গান’ (১৯৭০), ‘ভাটিয়ালী’ (২০১২); আর দ্বিতীয়োক্ত ধারার কাব্যসংকলন ‘কিছু রেখে যেতে চাই’ (২০০৯), ‘হে আমার দেশ’ (২০১৮)।

মাটির এ পৃথিবীতে মানুষের জীবন নেহাতই ক্ষণস্থায়ী। স্বল্পায়ু এ মানবজীবনে ‘পথপাশে মূর্ছাহত ধূলিমøান’ দুস্থ-বিপন্ন মানুষের জন্যে ‘দুই ফোঁটা অশ্রু’পাতকেই কবি পরম গৌরব জ্ঞান করেন। মানবীয় এ সংবেদনা ‘জীবন’ শীর্ষক সনেটে দার্শনিক ব্যঞ্জনায় অভিব্যক্ত : ‘পথপাশে মূর্ছাহত ধূলিমøান কখনো তোমাকে/দেখে যদি দিতে পারি দুই ফোঁটা অশ্রু সেই দুখে,/সে আমার পরম গৌরব বলে তাকে আমি মানি।/এর চেয়ে দামি কোনো বস্তুর সন্ধান কোনো জ্ঞানী/দেয়নি আমাকে এই পৃথিবীর বিষম কৌতুকে,/দু’দিনের হে জীবন কোনো দোষ দিও না আমাকে।’ জীবন, কিছু রেখে যেতে চাই

স্বল্পায়ু জীবনে কবি তাঁর নিজের জন্যে, তাঁর উত্তরপুরুষের জন্যে, এবং মানুষের জন্যে যৎকিঞ্চিৎ রেখে যাবার আকুতি ঝরান পঙ্িক্তপরম্পরায় : ‘যখন ধূসর সন্ধ্যা নামবে আমার চারদিকে/আর আমি কিছুই দেখতে বা শুনতে/পাবো না, তখন/অন্ধ বধিরের মতো কেবলি দু’হাতে/খুঁজবো মানুষ/অন্তত একটা লাঠিÑ/আমাকে চলতে হবে/চলতে চলতে যেন হোঁচট খেয়ে না পড়ি/কিছু রেখে যেতে চাই।’ কিছু রেখে যেতে চাই, কিছু রেখে যেতে চাই

সমকালে আবদুল হাই মাশরেকীর রচনাকর্মের ওপর যথোচিত আলোক-সম্পাতের অভাবে প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতিলাভে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁর সাহিত্যকর্মের আলোচনা-সমালোচনা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর। ‘পূর্ব বাংলার কবিতা’ (১৯৫৪) সংকলনগ্রন্থে আবু হেনা মোস্তফা কামাল লিখেছেন : ‘পূর্ব বাংলার আধুনিক কাব্যসাহিত্যে গ্রামীণ জীবনের প্রতিনিধিত্ব করছেন মাশরেকী। তাঁর পরিচয় শুধু মাঠ ও মাটির সঙ্গেই নিবিড় নয়, যে মানুষ মাঠের মাটিতে ফসল ফলায়, হাসে, কাঁদে, গান গায়, তাদেরও তিনি দেখছেন রঙিন কাব্যময় দৃষ্টি নিয়ে। তাঁর অনুভূতিতে অবাস্তবতার খাদ নেই, সর্বত্রই একটা বাস্তবানুগ সামগ্রিকতার পরিচয় দীপ্তিমান।’

ঐতিহ্যপ্রেমিক কবি আবদুল হাই মাশরেকীর সৃজন-বেদনা প্রকাশের প্রধান মাধ্যম কবিতা। তাঁর লেখা বহু কবিতা, গান ও ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে নানা পত্রিকায়। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর গ্রন্থ-প্রকাশনা একেবারে নগণ্য। জীবদ্দশায় কবির প্রকাশিত গ্রন্থপঞ্জি : কুলসুম ( ছোটগল্প; ১৯৫৪), বাউল মনের নকশা (ছোটগল্প; ‘কুলসুম’ গ্রন্থের বর্ধিত ৩য় সং. ১৯৭১), সাঁকো (একাঙ্কিকা; ১৯৬০), দুখু মিয়ার জারী (নজরুল-জীবনী-কাব্য ও পল্লিগীতিকা সংকলন; ১৯৬১), আকাশ কেন নীল (অনুবাদ; শিশুতোষ

বিজ্ঞান; ১৯৬২), মাঠের কবিতা মাঠের গান (কবিতা; ১৯৭০) ও নতুন গাঁয়ের

কাহিনী (নাটক; ১৯৭০)।

কবির অন্তর্ধানের পরে প্রকাশিত গ্রন্থ : নদী ভাঙে (ছোটগল্প; ১৯৯১), কিছু রেখে যেতে চাই (কবিতা; ২০০৯), মানুষ ও লাশ (ছোটগল্প; ২০১০), ভাটিয়ালী (কবিতা; ২০১২), বাংলাদেশের জয়গান (জারিকাব্য; ২০১৮), রাখাল বন্ধু (পালাগান; ২০১৮), জরিনা সুন্দরী (পালাগান; ২০১৮), হে আমার দেশ (কবিতা; ২০১৮) ইত্যাদি।

বাংলা গানের ভুবনে বিশিষ্ট গীতিকার হিশেবে মাশরেকীর নাম বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। বহু গান লিখেছেন তিনি। যৌবনের প্রারম্ভে তিনি কলকাতার এইচএমভি’র সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়ে গান রচনা করেন। ১৯৬৮তে ঢাকাস্থ গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গেও গীতিকার হিশেবে তিন বছরের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন। ঢাকা বেতারেরও তালিকাভুক্ত গীতিকার ছিলেন তিনি। মাশরেকী-রচিত কয়েকটি গানের কলি: ওরে আমার ঝিলাম নদীর পানি/তারা মরে নাই, তারা যে অমর/এসো গণতন্ত্র গড়ে তুলি নতুন দিনের/বাংলা মা তোর শ্যামল বরণ/আমার বাড়ি যাইও বন্ধু/একদিন হবে ভুলিতে/ একটি কথা শুনবে যদি শোনো/ চিরদিনের সেই পুরোনো কথা ক’টি/পড়ি তাসমিয়া পড়ি বিসমিল্লাহ।

১৯৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর দত্তপাড়ায় নিজ বাড়িতে আবদুল হাই মাশরেকী পরলোকগমন করেন। মহান এ কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *