ভুয়া ময়না তদন্ত প্রতিবেদন

ভুয়া ময়না তদন্ত প্রতিবেদন: কাগজে-কলমে পশু মৃত্যু দেখিয়ে আত্বসাৎ

সাভারে অবস্থিত কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মোট ৭৩টি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, ‘মৃত পশুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন তৈরী করা বাধ্যতামূলক এবং ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তারের নাম, স্বাক্ষর ও সীল থাকা বাঞ্ছনীয়’।

কিন্তু তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে পাওয়া ৭২টি পশু মৃত্যুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, ‘৫৯টি মৃত পশুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ভেটেনারি সার্জন (ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তা) ডাক্তারের নাম নেই’। আছে শুধু প্যাঁচানো-প্যাঁচানো স্বাক্ষর। এসব ভুয়া প্রতিবেদন তৈরীর মাধ্যমে ‘কাগজে-কলমে পশু মৃত্যু দেখিয়ে, আত্বসাৎ করা হয়েছে কয়েক কোটি টাকা’।

তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষন করে, ‘কাগজে-কলমে মৃত্যু দেখিয়ে গবাদি পশু আত্বসাৎ করার এই অভিনব দূর্ণীতির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে’। প্রাপ্ত তথ্য মতে, কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মোট ৭৩টি গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। এসব মৃত গরু গুলোর মধ্যে মাত্র ১৩টি গরুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ভেটেনারি সার্জন (ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তা) ডাক্তারের নাম ও স্বাক্ষর আছে, তবে সীল নেই। ১টি গরুর ময়না তদন্ত করা হয়নি। আর বাকি ৫৯টি গরুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন ভুয়া।

খামারটিতে মৃত ৭৩টি গরুর মধ্যে প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর সংখ্যা ১৩টি এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক গরুর সংখ্যা ৬০টি। প্রাপ্ত ৭২টি ময়না তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা যায়, “অফিস চলাকালীন সময় সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মোট ১৯টি মৃত গরুর ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে, অফিস ছুটির পর রাতে করা হয়েছে ৫৩টি গরুর ময়না তদন্ত।” প্রাপ্ত ৭২টি প্রতিবেদনের মধ্যে ৫৯টি প্রতিবেদনে ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম না থাকলেও, বেশির ভাগ প্রতিবেদনে ভেটেনারি অফিসার হিসেবে আব্দুল মোত্তালীবের নাম উল্লেখ রয়েছে। আরও গুরুতর বিষয় হচ্ছে, ‘৫টি প্রতিবেদনে ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ভেটেনারি অফিসার কারোই নাম নেই’। শুধু অদৃশ্য কর্তার স্বাক্ষর আছে।

মৃত পশুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তারের নাম নেই কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে ভেটেনারি অফিসার আব্দুল মোত্তালীব বলেন, ‘ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তারের নাম না থাকার তো কথা নয়। হয়তো ভুল বশত: ডাক্তারের নাম বাদ পড়েছে’। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে পরে আপনার সাথে কথা বলবো।

প্রাপ্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আব্দুল মোত্তালীব ৫টি ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ভেটেনারি অফিসার হিসেবে স্বাক্ষর করার পাশাপাশি ময়না তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবেও স্বাক্ষর করেছেন। আব্দুল মোত্তালীন একাই উভয় পদের দায়িত্ব পালন করে মৃত ৫টি গরুর ময়না তদন্ত সম্পন্ন করেছেন।

একই ব্যক্তি ভেটেনারি অফিসার ও তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে উভয় পদে স্বাক্ষর করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় গো-প্রজনন ও দুগ্ধ খামারের পরিচালক ডাঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আপনাকে প্রদানকৃত তথ্য না দেখে, এপ্রসঙ্গে মন্তব্য করা সম্ভব না’। আর ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তারের নাম না থাকার প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে চাইলে পরিচালক ডাঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে ডাক্তারের নাম থাকা বাঞ্ছনীয়’।

এঁড়ে গরু ময়না তদন্তে বকনা!
৭৭৪৮ ক্রমিক নম্বরের গরুটির ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ফিজিয়ান জাতের এই বকনা (মেয়ে) গরুটি ক্রোমিক নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালের ২৮ মার্চ ভোর ৬:০০ টায় মারা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ‘সরকারি দুগ্ধ খামারটির পশু মৃত্যুর মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, ৭৭৪৮ নম্বরের এই গরুটি একটি এঁড়ে (ছেলে) গরু’।

ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে গুরুতর অসঙ্গতি
৭৭৫২ নম্বরের এই গরুটি একটি পুরুষ গরু। গরুটির ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই পুরুষ গরুটির পুংলিঙ্গ থাকার পাশাপাশি যোনী, জরায়ু, ডিম্বাশয় ও ডিম্বনালী রয়েছে’। এছাড়া ৭৭৪৩ নম্বর গরুটি একটি মহিলা গরু। গরুটির ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই মহিলা গরুটির যোনী থাকার পাশাপাশি অন্ডকোষ আছে’।

প্রাপ্ত প্রতিবেদন সমূহ পর্যালোচনা করে আরও জানা যায়, মোট ১২টি পুরুষ ও ৪টি -মহিলা গরুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে এমন গুরুতর ভুল রয়েছে। এসব মৃত গরু গুলোর মধ্যে ১০টি পুরুষ গরুর পুংলিঙ্গ নাই কিন্তু যোনী ও জরায়ু আছে। ২টি পুরুষ গরুর উভয় লিঙ্গ আছে। এছাড়া ৩টি মহিলা গরুর যোনী নেই এবং ১টি মহিলা গরুর যোনী ও অন্ডকোষ উভয়ই আছে’।

এখানেই শেষ না। উল্লেখ্য প্রাপ্ত ৭২টি ময়না তদন্ত প্রতিবেদনের মধ্যে ১৩টি প্রতিবেদনে মোট ৩ জন ভেটেনারি সার্জন (ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তা)র নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন- ডা: দিদারুল আহসান, ডা: কামরুল হাসান ও ডা: সুব্রত সেন বিশ^াস। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ‘ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম থাকা ১টি প্রতিবেদনেও তথ্যগত ভুল রয়েছে’। ৮০৯৮ নম্বরের গরুটির ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই পুরুষ গরুটির পুংলিঙ্গ ও অন্ডকোষ থাকার পাশাপাশি জরায়ু ও ডিম্বাশয় আছে’। এই গরুটির ময়না তদন্ত করেছেন ডা: সুব্রত সেন বিশ^াস।

উভয় লিঙ্গের কাল্পনিক এসব গরুর ময়না তদন্ত প্রতিবেদন তৈরী করার মাধ্যমে কাগজে-কলমে মৃত্যু দেখিয়ে, সরকারি খামারটির গবাদি পশু আত্বসাৎ করা হয়েছে।

কাগজে-কলমে মৃত্যু দেখিয়ে গবাদি পশু আত্বসাৎ করার প্রসঙ্গে মুঠোফোনে বক্তব্য জানতে চাইলে এস এম আউয়াল (সাবেক পরিচালক) বলেন, আমি বছর খানেক আগেই অবসর গ্রহন করেছি। ঐ সময়ের সব কথা মনে নেই। তবে, আপনাকে প্রদানকৃত ময়না তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আমি, অবশ্যই খোঁজ নিব।

গরুর বয়স কম দেখিয়ে আত্বসাৎ
৭০৯৬ ক্রমিক নম্বরের গরুটির ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এই বকনা (মেয়ে) গরুটি ২০২১ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাত ৩:৫০ মিনিটে মারা যায় এবং সকাল ৭:৩০ মিনিটে গরুটির ময়না তদন্ত করা হয়। প্রতিবেদনে গরুটির বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ১৯ দিন। কিন্তু খামারটির পশু মৃত্যুর মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘৭০৯৬ ক্রমিক নম্বরের গরুটি ২৯ ডিসেম্বর না, মারা গেছে ২৫ ডিসেম্বর। প্রতিবেদনে পশুটির জন্ম তারিখ (২৭.০২.২০১৯) উল্লেখ করা হয়েছে’। তারমানে, ২ বছর ২ মাস বয়সের প্রাপ্ত বয়স্ক গরুটিকে, কাগজে-কলমে দেখানো হয়েছে মাত্র ১৯ দিন বয়সী বাছুর হিসেবে।

খামারটির বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে মোট ১৩টি প্রাপ্ত বয়স্ক গরুর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু খামারটির পশু মৃত্যুর মাসিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা জানা যায়, উল্লেখিত অর্থ বছরে প্রাপ্ত বয়স্ক মৃত গরুর সংখ্যা ২৬টি। তারমানে, ‘প্রাপ্ত বয়স্ক মৃত ২৬টি গরুর মধ্যে ১৩টি গরুকে অপ্রাপ্ত বয়স্ক গরু হিসেবে দেখানো হয়েছে’। প্রাপ্ত বয়স্ক এই ১৩টি গরুর বাজার মূল্য কোটি টাকার উপরে।

অধিক সংখ্যক বাছুরের মৃত্যু
২০২১-২০২২ অর্থ বছরে খামারটিতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মৃত বাছুরের সংখ্যা ৬০টি। মৃত বাছুর গুলোর মধ্যে এঁড়ে (ছেলে) গরু ২৭টি এবং বকনা (মেয়ে) গরু ৩৩টি। এর মধ্যে দিনে মারা গেছে ১৩টি বাছুর এবং রাতে মারা গেছে ৪৭টি বাছুর। মৃত বাছুর গুলোর মধ্যে ১ মাস বয়সী বাছুরের সংখ্যা ২৭টি। এসব মৃত ৬০টি বাছুরের মধ্যে ৫১টি বাছুরের ময়না তদন্ত প্রতিবেদন ভুয়া।

অধিক সংখ্যক বাছুরের মৃত্যুর প্রসঙ্গে সরেজমিনে দুগ্ধ খামারটির সাধারণ কর্মী (গোয়ালা) ও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খামারটিতে প্রায় প্রতিদিনই বাছুরের জন্ম হয়। খামারটিতে প্রতি মাসে গড়ে ১ থেকে ২টি বড় গরুর মারা যায়। কিন্তু বাছুর মৃত্যুর ঘটনা খুবই কম।

কাকতালীয় মৃত্যু!
মৃত গবাদি পশুর তথ্য পর্যালোচনা করে জানা যায়, ‘খামারটিতে মৃত ৭৩টি গরু ভিন্ন ভিন্ন তারিখে মারা গেলেও, কাকতালীয় ভাবে ৫২টি গরুর মৃত্যুর সময় এক। কেবল ভোর রাত ৪:৩০মিনিটে মারা গেছে সর্বচ্য ৭টি গরু। এছাড়া রাত ১:১৫ মিনিটে মারা গেছে ৩টি গরু, রাত ৩:০০ টায় মারা গেছে ৩টি, রাত ৩:৩০ মিনিটে ৪টি, ভোর ৪:০০ টায় মারা গেছে ৪টি, ভোর ৫:৩০ মিনিটে ৩টি, ভোর ৬:৩০ মিনিটে ৬টি, সকাল ৭:৩০ মিনিটে ৬টি এবং সকাল ৮টায় মারা গেছে ৪টি গরু।

একই সময়ে একাধিক গরু মৃত্যুর বিষয়ে সরকারি খামারটির এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘গরু আলাদা-আলাদা সময়ে মারা যাওয়াটাই স্বাভাবিক’। তবে বড় কোন রোগের পাদুর্ভাব হলেই কেবল, একই সময়ে একাধিক পশুর মৃত্যু হতে পারে।

সূত্র ঢাকা প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *